পটভূমি :
রোগ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে অসহায় করে তোলে। দূর্দশাগ্রস্ত দরিদ্র রোগীদের জন্য অসুস্থতা আরও বেশি পীড়াদায়ক। রোগগ্রস্ত মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতাল সমাজকর্মের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা অপরিসীম। সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের মধ্যে ‘হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম’ একটি দৈনন্দিন সেবাধর্মী গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম, যা দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় ও আর্ত-পীড়িতদের সেবার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র, অসহায় রোগীদের মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অসুস্থতা বিষয়ক বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে রোগীর মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, চিকিৎসার ব্যয় বহন, চিকিৎসককে রোগীর রোগ ও রোগের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রদান এবং চিকিৎসা শেষে তার পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৫৮ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এর উদ্যোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ (দুই) জন চিকিৎসা সমাজকর্মী নিয়োগ করা হয়। এ কর্মসূচি বিশেষ ফলপ্রসূ হওয়ায় ১৯৬১ সালে সমাজকল্যাণ পরিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হবার পর চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকাস্থ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এ প্রকল্প সম্প্রসারণ করা হয়। এভাবে মোট ৩৮ জন চিকিৎসা সমাজকর্মী নিযুক্ত হন। অতঃপর তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে দেশের ১২টি হাসপাতালে ১২টি ইউনিট এবং পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে ঢাকা মহানগরীতে ২টি, খুলনা শহরে ১টি ও নতুন জেলা সদরে ৩৩টি সর্বমোট ৩৬টি হাসপাতালে উন্নয়ন খাতে ৩৬টি ইউনিট চালু করা হয়। কার্যক্রম ফলপ্রসূ হওয়ায় ১৯৯৪ সালে আরও ৮টি হাসপাতালে ইউনিট চালু করা হয়। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীসহ ৬৪টি জেলায় জেলা পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১০৫ টি ইউনিট এবং উপজেলা পর্যায়ে ৪২০ টি উপজেলা হেল্থ কমপ্লেক্সে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার মোট সংখ্যা-৫২৫টি। এই কার্যক্রমটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমাজসেবা অধিদফতরাধীন প্রতিটি হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর আওতায় নিবন্ধিত ‘রোগীকল্যাণ সমিতি’ রয়েছে।
হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
- রোগীর সাথে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের (Rapport building) মাধ্যমে রোগের ইতিহাস জানা এবং কাউন্সেলিং (Counseling) ও প্রেষণার (Motivation) মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ ও রোগ নিরাময়ে সক্ষম করে তোলা;
- দরিদ্র ও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অক্ষম রোগীকে ঔষধ, পথ্য, রক্ত, চিকিৎসা সহায়ক উপকরণ, যাতায়াত ভাড়া, লাশ পরিবহন ও মৃতের সৎকার এবং রোগ নির্ণয় সংক্রান্ত পরীক্ষার খরচ ইত্যাদি খাতে সহায়তা দিয়ে পরিপূর্ণ সুস্থতার পথ সুগম করা;
- হাসপাতালে পরিত্যক্ত ও অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে যথাক্রমে শিশু আইন, ২০১৩, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ এবং বিদ্যমান অন্যান্য আইন অনুসারে সামাজিকভাবে পুনর্বাসন;
- হাসপাতাল থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত কর্মক্ষম, সহায় সম্বলহীন ব্যক্তিকে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলা;
- বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা এবং প্রতিবন্ধী রোগীকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সেবা দান ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সহায়তা দানের মাধ্যমে অধিকার নিশ্চিত করা;
- ক্যান্সার, কিডনী, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, থ্যালাসেমিয়াসহ জটিল রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে সেবা দান ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সেবা প্রাপ্তিতে সহায়তা করা;
- পরিবার-পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং সব ধরনের সংক্রামক ও জটিল রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি;
- ক্ষেত্রমত, রোগীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ এবং রোগীর গৃহ পরিদর্শনসহ পারিবারিক সমস্যা নিরসন, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ়ীকরণ, পরিবার তথা সমাজে পুনঃএকীকরণে সহায়তা দান;
প্রদেয় সেবাসমূহ:
- মানসিক সেবা:
- অপারেশন ও অপারেশন পরবর্তী স্ট্রেস ডিসওর্ডার এবং দূরারোগ্য রোগের ক্ষেত্রে রোগীর মনোবল বৃদ্ধি ও সাহস যোগানো;
- হাসপাতালে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে আগত নির্যাতিত নারী ও শিশুদের মনোবল বৃদ্ধিতে এবং হাসপাতালে আগত অন্যান্য সেবাগ্রহীতাকে মোটিভেশন ও কাউন্সেলিং সেবা প্রদান ; এবং
- মানসিক ও মাদকাসক্ত রোগীদের মানসিক উন্নয়নে সহায়তার পাশাপাশি অভিভাবকদের মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ ও পরামর্শ প্রদান।
- সামাজিক সেবা :
- হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা প্রাপ্তিতে সহায়তা;
- সমাজসেবা অধিদফতরাধীন বিভিন্ন চিকিৎসা সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, থ্যালাসেমিয়া ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীকে সাহায্য প্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণ;
- জটিল রোগসমূহ যেমন-ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, যক্ষ্মা, এইডস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরে সহযোগিতা প্রদান;
- অজ্ঞাত রোগীর ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
- প্রয়োজনে রোগীর গৃহ পরিদর্শন, ফলোআপ ও পরিবারবর্গের সাথে যোগাযোগ;
- শিশু, প্রতিবন্ধী, হিজড়া ব্যক্তি ও প্রবীণদের চিকিৎসা সেবায় অগ্রাধিকার প্রদান;
- আশ্রয়হীন, ঠিকানাবিহীন ও পরিত্যক্ত শিশু অথবা ব্যক্তির চিকিৎসাসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদফতরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ;
- পরিবার-পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে নিয়মিত ইনডোর ও আউটডোর রোগীদের কাউন্সেলিং ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সেবাদান;
- ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন এবং প্রচারণামূলক লিফলেট, ব্রুসিয়ার ইত্যাদি প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ; এবং
- ক্ষেত্রমত, রোগীদের চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ, যেমন: টিভি, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন ইত্যাদির কর্ণার, শিশু খেলাঘর ইত্যাদি স্থাপন।
- আর্থিক সেবা :
- বহিঃ ও অন্তঃবিভাগে চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারী অসহায়, দুস্থ ও দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বস্ত্র, পথ্য, রক্ত, লাশ পরিবহন, মৃতের সৎকার, যাতায়াত ভাড়া, কৃত্রিম অঙ্গ, চিকিৎসা সহায়ক সামগ্রী এবং অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদান। ক্ষেত্রমত, রোগীর সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ফ্রি চিকিৎসা গ্রহণের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ।
রোগীকল্যাণ সমিতির আয়ের উৎস :
- বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ ও অন্যান্যভাবে প্রাপ্ত সরকারি অনুদান;
- সাধারণ ও আজীবন সদস্য চাঁদা;
- দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাকাত, দান, অনুদান হিসাবে প্রাপ্ত নগদ অর্থ;
- দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাপ্ত চিকিৎসা সহায়ক দ্রব্যসামগ্রী;
- বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাপ্ত নগদ অর্থ ইত্যাদি।
সেবাগ্রহিতা:
হাসপাতালে আগত দরিদ্র, অসহায় ও দুঃস্থ রোগী।
সেবাদানকারী হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়সমূহ:
- জেলা সদরে অবস্থিত ৫৮ টি সরকারি জেনারেল/সদর হাসপাতাল;
- ২১ টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল;
- ২৬ টি বিশেষায়িত হাসপাতাল;
- উপজেলা পর্যায়ে ৪২০ টি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে অবস্থিত রোগীকল্যাণ সমিতি;
- যে, রাজস্ব খাতে পরিচালিত হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ৯৪ টি।
সেবা প্রাপ্তির সময়:
- কর্মদিবসের সকাল ৮.০০ মি: হতে দুপুর ২.৩০ মি: অথবা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের নিজস্ব অফিস সময়সূচি।
সেবা প্রদানের সময়সীমা:
- রোগী চিহ্নিত হওয়া বা রোগী আবেদন করার পর তাৎক্ষনিকভাবে;
প্রয়োজনীয় ফি/ট্যাক্স/ আনুসংঙ্গিক খরচ
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা :
- সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল সমাজসেবা অফিসার, হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয় এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার;
- রোগীকল্যাণ সমিতির সভাপতি/ হাসপাতাল প্রধান;
নির্দিষ্ট সেবা পেতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রতিকারকারী কর্মকর্তা :
- জেলার ক্ষেত্রে:
- বিভাগীয় পরিচালক,সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
- উপপরিচালক, সংশ্লিষ্ট জেলা।
- সদর দফতরের ক্ষেত্রে :
- পরিচালক(কার্যক্রম), সমাজসেবা অধিদফতর, ঢাকা।
- অতিরিক্ত পরিচালক (কার্যক্রম-১), সমাজসেবা অধিদফতর, ঢাকা।
- উপপরিচালক (চিকিৎসা ও প্রবেশন), সমাজসেবা অধিদফতর, ঢাকা।
সংশ্লিষ্ট আইন/বিধি/নীতিমালা
- হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা-২০১১
- স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুসারে সংশ্লিষ্ট রোগীকল্যাণ সমিতির গঠনতন্ত্র;
নাগরিকের সহযোগিতার ক্ষেত্র :
- দরিদ্র রোগী সম্পর্কে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ে অবহিতকরণ;
- কার্যক্রম পরিচালনায় কোন ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা;
- রোগীকল্যাণ সমিতির সাধারণ ও আজীবন সদস্য হওয়া;
- রোগীকল্যাণ সমিতিতে যাকাত, দান, অনুদান ইত্যাদি আর্থিক সহায়তা করা;
- রোগীকল্যাণ সমিতিতে চিকিৎসা সহায়ক সামগ্রী দান;
- রোগীদের প্রতি সহমর্মী আচরণ করা;